‘৫ আগস্ট বিকেল ৩টার দিকে কুষ্টিয়া মডেল থানার সামনে আন্দোলন চলছিল। এসময় আমার ছেলেকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে এসআই সাহেব আলী। প্রকাশ্যে সাহেব আলী নিজে হাতে আমার ছেলেকে টেনে নিয়ে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। বুকের এক পাশে গুলি করায়, বুক ভেদ করে অন্য পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে এসআই সাহেব আলী আমার ছেলেকে হত্যা করেছে।’
কথাগুলো বলছিলেন নিহত আব্দুল্লাহর বাবা লোকমান হোসেন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ১৩ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ। ৫ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে কুষ্টিয়া শহরের থানার মোড়ে আব্দুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আব্দুল্লাহ শহরের চর থানাপাড়া এলাকার লোকমান হোসনের ছেলে। কুষ্টিয়া ফায়ার সার্ভিস গেট সংলগ্ন চায়ের দোকানে বাবার সঙ্গে কাজ করতো আব্দুল্লাহ।
আব্দুল্লাহর বাবা লোকমান হোসন আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলে হত্যার ঘটনা এক বছর হতে চলেছে, কিন্তু আমার ছেলে হত্যার বিচার পাচ্ছি না। এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা একেবারেই নিরব। পুলিশের কোনো আগ্রহ নেই, জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় না। আমার ছেলে জুলাই আন্দোলনে জীবন আত্মত্যাগ করল, আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার পাইলাম না। এসআই সাহেব আলী প্রকাশ্যে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যার পরও চাকরি করে কিভাবে? আমি এস আই সাহেব আলীর ফাঁসি চাই। প্রকাশ্যে মার্ডার করে এখনো কিভাবে সাহেব আলী ও মুস্তাফিজ চাকরি করে?
তিনি আরও বলেন, আমি অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আমার ছেলে আব্দুল্লাহও হাসপাতালে আমার কাছে ছিল। সে ভাত খাওয়ার কথা বলে হাসপাতাল থেকে বের হয়। এরপর কুষ্টিয়া মডেল থানার সামনে আন্দোলনে যুক্ত হয়। আন্দোলনরত অবস্থায় আমার ছেলেকে ধরে দুই হাত ভেঙে দিয়েছিল এসআই সাহেব আলী। এরপর বুকে গুলি করে হত্যা করে। আওয়ামী লীগের হানিফ এমপি ও তার ভাই আতার নির্দেশে এসআই সাহেব আলী আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি, দ্রুত যেন এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়। সাহেব আলী আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। তার গুলিতে অনেকে আহত এবং নিহত হয়েছেন।
আব্দুল্লাহ হত্যার ঘটনায় ১৫ আগস্ট রাতে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি মামলা হয়। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিসহ মোট ১৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ১০-২০ জনকে। মামলার বাদী আব্দুল্লাহর বাবা লুকমান হোসেন।
এই মামলার বিষয়ে লোকমান বলেন, আমি অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এ সময় দলীয়ভাবে এই ঘটনায় মামলাটা করা হয়েছিল। যার কারণে এই মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছিল, না হয়েছিল আমি জানতাম না। তবে সেই মামলায় আসামি হিসেবে সাহেব আলীর নাম ছিল না। পুলিশে তার নাম দিতে দিয়েছিল না, তাকে আসামি করতে দেওয়া হয়েছিল না। এরপর ট্রাইব্যুনাল থেকে লোক এসেছিল। ওদের কাছে চারজনকে আসামি করে মামলা করেছি। সাহেব আলী, আওয়ামী লীগের সদরের এমপি হানিফ, তার ভাই আতা ও মানব চাকির নামে অভিযোগ দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, এসআই সাহেব আলী কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই ছিল। সে আওয়ামী লীগের দোসর। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাহেব আলী মাদক ব্যবসা, হত্যা, গুম, ঘুষ বাণিজ্য, মামলা বাণিজ্য, নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে চাঁদাবাজি করাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তার আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ড ছিল বেপরোয়া। জুলাই আন্দোলন শুরু থেকেই সাহেব আলী আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের হুমকি ধামকি দিত। শুধু তাই নয় আন্দোলন চলাকালীন অবস্থায় আন্দোলনকারীদের উপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, মারপিট করা, গুলি করা সহ বিভিন্নভাবে স্বৈরাচারী উগ্র ও খুনির আচরণ করেছে। সাহেব আলীর গুলিতে অনেক আন্দোলনকারী আহত ও নিহত হয়েছে।
এসআই সাহেব আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি আরও বলেন, সাহেব আলী আন্দোলনকারীদের ওপর নিজে গুলি চালিয়েছে। আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গুলি চালিয়েছে। নারী ও পুরুষদের মারপিট করেছে। আমার ছেলের মতো কয়েকজনকে হত্যা করেছে। এটা সবাই জানে, সবাই দেখেছে। সেই খুনী সাহেব আলী কিভাবে এখনো পুলিশে চাকরি করে? সে বর্তমানে খাগড়াছড়িতে কর্মরত আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই মুস্তাফিজও সাহেব আলীর সঙ্গে থেকে সব অপরাধ করেছে। সাহেব আলী ও মোস্তাফিজ দুজনে মিলেই এ সমস্ত সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড করেছে। তাদের শাস্তি চাই। তারা কিভাবে এখনো চাকরি করে?
নিহত আব্দুল্লাহর বোন রিনা খাতুন বলেন, ৫ আগস্ট আমার ভাই থানার সামনে আন্দোলন করছিল। এসময় সাহেব আলী আমার ভাইয়ের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। প্রথমে ধরে মারধর করে এবং আমার ভাইয়ের দুই হাত মুছড়ে ভেঙে দেয়। এরপর গুলি করে হত্যা করে। এসআই সাহেব আলী ও এসআই মুস্তাফিজসহ এ ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসি চাই। হত্যার এক বছর হতে চলছে, কিন্তু তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। তাদের চাকরিও বহাল রয়েছে। তারা এখনো চাকরিরত অবস্থায় আছে। তাদেরকে দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়া হোক।
আব্দুল্লাহর ফুফাতো বোন মোমেনা খাতুন বলেন, আব্দুল্লাহকে প্রকাশ্যে হাজার হাজার মানুষের সামনে গুলি করে হত্যা করেছে এসআই সাহেব আলী। আমরা সাহেব আলীর শাস্তি চাই। আব্দুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত সবার শাস্তি চাই, ফাঁসি চাই।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের সাবেক উপ পরিদর্শক (এসআই) সাহেব আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আব্দুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply