রাজধানীর গুলশানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) বহিষ্কৃত যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপুর একটি ভিডিও বার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
বুধবার প্রকাশ পাওয়া অপুর ৩৫ মিনিটের ভিডিও বার্তা ঘটনার নতুন মাত্রা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। গ্রেফতার হওয়ার আগে করা এ ভিডিওতে তিনি গুলশানে চাঁদাবাজির বিস্তারিত তথ্য ও এর পেছনে কারা রয়েছে ভিডিও তা তুলে ধরেন।
সেখানে তিনি ওই চাঁদাবাজির ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রকারান্তরে বোঝানো হয়, এ ঘটনার সঙ্গে আসিফ মাহমুদের সম্পৃক্ততা আছে। এমনকি জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শীর্ষ সমন্বয়কদের ইঙ্গিত করেও তিনি কিছু বক্তব্য দেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে এলজিআরডি এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বুধবার সাংবাদিকদের কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন।
অপরদিকে অপুর স্ত্রী আনিশা বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের লোকজন তার স্বামী অপুকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে এভাবে ভিডিওতে কথা বলতে বাধ্য করেন।
সংবাদ সম্মেলনে অপুকে অপহরণের অভিযোগ করে স্ত্রী আনিশা বলেন, জানে আলম অপুকে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের লোকজন তুলে নিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে ভিডিও ধারণ করেছেন। বৃহস্পতিবার শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।
আনিশা বলেন, গ্রেফতার হওয়ার সঠিক সময় প্রকাশ না করে কোর্টে তোলার আগে অপুকে দিয়ে জোর করে নানা বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। এনসিপি নেতাদের ফাঁসাতে এবং দাবিয়ে রাখতে একটা দল নাটক সাজিয়েছে। অপুর কাছ থেকে বারবার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামের নাম শুনতে চাওয়া হয়।
কোনোরকম চাঁদাবাজিতে তার স্বামী জড়িত নন দাবি করে আনিশা বলেন, অপু মূলত ভুল বোঝাবুঝি ও মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার। অপুকে দিয়ে জোর করে ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। গ্রেফতার হওয়ার পর কোর্টে তোলার আগে এ ভিডিও ধারণ করা হতে পারে।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে যুগান্তরের পক্ষ থেকে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে একাধিকবার ফোন করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ভিডিও বার্তায় যা বলা হয়: ভিডিও বার্তায় অপু দাবি করেন, ১৭ জুলাই ভোর ৪টা ১০ থেকে ৪টা ৪০ মিনিটের মধ্যে গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনের নিচে সাদা সিএফ মোটরবাইকে হেলমেট লাগানো অবস্থায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার সঙ্গে কথা বলেন। এর পরই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আরেক নেতা রিয়াদকে (বহিষ্কৃত) সঙ্গে নিয়ে সাবেক এমপি শাম্মীর বাসায় গিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা আনেন তারা। ওই বাসা থেকে মোট এক কোটি টাকা চাঁদা নেওয়ার নির্দেশ ছিল বলেও দাবি অপুর।
অপু বলেন, যে সিসিটিভি ফুটেজ আপনারা দেখেছেন ওখানে টাকার ব্যাগ হাতে কালো টি-শার্ট পরা যে ছেলেটা ছিল সেটা ছিলাম আমি। আপনারা এই সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমেই জেনেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা চাঁদাবাজিতে জড়িত। যে সমন্বয়করা গত বছর আন্দোলনে আপনাদের কাছে মহানায়ক ছিল; তারা হয়ে গেল চাঁদাবাজ। কিন্তু আমার কিছু প্রশ্ন আছে এখানে। আপনারা কি জানেন, টাকা নেওয়ার ফুটেজটা সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে। এর ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে ভোর ৫টার সময় ওই জোনের ডিসি, ওসি সবাইকে অবগত করে একদম অফিশিয়াল প্রক্রিয়ায় আইনিভাবে পুলিশ বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে শাম্মীর সেই বাসায় আমরা অভিযান চালায়। আপনারা কি জানেন, সেই অভিযানে যাওয়ার আগে গুলশানেরই কোনো একটা জায়গায় আমার সঙ্গে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের কথা হয়। অথচ মিডিয়ায় শুধু চাঁদার টাকা নেওয়া ২ মিনিটের ফুটেজটা কেন এলো। আগের রাতে গোটা অভিযানের বিষয়টাকে ধামাচাপা দেওয়া হলো কেন। ভোর ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত টানা এক ঘণ্টা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে শাম্মী আহমেদের বাসায় অভিযান চলে।
তিনি বলেন, পরদিন সকালে রিয়াদ আমাকে ফোন দিয়ে ডেকে নেয়। রিয়াদ আমাকে বলে ভাই বাসায় আসতে হবে, আমাদের কাছে তথ্য আছে শাম্মী এখনো বাসায় আছে। আমি দ্রুত সেখানে যাই। যাওয়ার পরে রিয়াদ আমাকে নিয়ে ভেতরে যায় এবং বলে ওপর থেকে ডেকে পাঠিয়েছে। আমি বলি ওকে, তাহলে চলো। সিঁড়িতে রিয়াদ আমাকে ইঙ্গিত দেয় ওরা (শাম্মীর পরিবার) কিছু টাকা-পয়সার কথা বলছে-পোলাপানকে চা-পানি খেতে টাকা-পয়সা দেবে। ভেতরে গিয়ে বসার পরেই শাম্মীর স্বামী এসে ৫ লাখ টাকা অফার করে। তিনি বলেন, আমি তোমাদেরকে ৫ লাখ টাকা দিচ্ছি তোমরা যারা ছিলে চা-পানি খেও। আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। সারা জীবন চাকরি করেছি। কোনো রাজনীতি করিনি। অবসরে এসে এখানে আছি। রেস্ট করতেছি-এই বয়সে এসে আমাদের আর হয়রানি করো না। একপর্যায়ে সে টাকা আনতে চলে যায়, তখন রিয়াদ যেটা রিপ্লাই করে সেটা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। রিয়াদ রিপ্লেতে বলল, কিসের পাঁচ লাখ। এক কোটির নিচে কথাই হবে না। আপনার মান-ইজ্জত সব বাঁচায় দিলাম। আত্মীয়স্বজনের কাছে কালার খাইতে হলো না-জেল খাটতে হলো না, কোনো কিছু করতে হলো না।
অপু বলেন, আমি ভাই রীতিমতো থ খেয়ে গেলাম। তখন এক রকম মাথা ধরে উঠছে আমার। এইটা কি তাহলে প্ল্যান ছিল? আমি রাতে বিভিন্ন ক্লু পাচ্ছিলাম শাম্মী বাসায় ছিল। তখন আমার মাথায় আসে এটা কি তাহলে প্ল্যান ছিল। প্ল্যান করে শাম্মীকে এরা সেইফ এক্সিট দিয়েছে। এর বিনিময়ে কোটি টাকা নিতে আসছে। ওরা বার্গেনিং চালাতে থাকে। এক কোটি থেকে ৫০ লাখে নামে।
১০ লাখ টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসার দাবি করে অপু বলেন, ‘বাইরে আসার পরে রিয়াদ আমার সঙ্গে প্রচণ্ড রাগারাগি শুরু করে। বলে ধুর মিয়া আপনি পাগল নাকি। আপনার জন্য হইল না।
ভিডিওর ১০ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে বলতে শোনা যায়, ১০ লাখ টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আমি রিয়াদরে ঝাড়ি মারছি। তখন রিয়াদ বলে, ‘ভাই তো আমারে এক কোটির কথাই বলে দিছে।’ পরে বলি কোন ভাই? কখন বলল তোকে? কার কার সঙ্গে কথা বলছিস আমি যাওয়ার পরে।
তখন রিয়াদ বলেন, রাতে কোন ভাই আসছিল দেখেন নাই। তখন আমি ৩০ সেকেন্ড চুপ করে থাকি, ভাবতে থাকি রাতে কোন ভাই আসছিল এইটার সমীকরণটা মাথায় মেলে এবং রিয়াদকে আমি বলি, যে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আসলাম তুই সেই ভাইয়ের কথা বলতেছিস। রিয়াদ বলে হ্যাঁ। আপনি বুঝতেছেন না। ওখানে ক্যামেরা আছে, সবকিছু আছে সেখানে আমি এক কোটি টাকা চাওয়ার সাহস করতেছি, এটা কি এমনি এমনি। তখন আমার কাছে একটু হলেও বিশ্বাস হয়। বুঝতে পারি, ওর পেছনে ব্যাকআপ আছে।
অপু বলেন, আমি নেমে আসার পরও রিয়াদ গেটে ওদের সঙ্গে বার্গেনিং করেছে দুদিন সময় দিয়ে আসছে। দুদিন পর আমরা আবার আসব এটা বলে আসছি।
আসিফ মাহমুদ যা বললেন : বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘জানে আলম অপুকে ২০২২ সালে চিনতাম। ৫ আগস্টের পর তার সঙ্গে কখনো দেখা বা কথা হয়নি। এ ধরনের ক্লেম আসার পর বেশ অবাক হয়েছি। চাঁদাবাজির সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, যা বলা হচ্ছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একজনের (অপু) যে স্টেটমেন্ট নেওয়া হয়েছে তা জোর করে নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।’
জানে আলম অপুর সঙ্গে তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে দেখা করতে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা আসিফ জানান, ‘রাতে মাঝেমধ্যে কাজ শেষ করতে ভোর হয়ে যায়, ওই সময় খাবার দেওয়ার জন্য বাসায় কেউ থাকে না। অনেক সময় ৩০০ ফিটের নীলা মার্কেটে যান। ওখানে হাঁসের মাংস ভালো পাওয়া যায়। বেশি ভোর হয়ে গেলে ওটা বন্ধ থাকে। তখন ওই দিকে হোটেল ওয়েস্টিনে যাওয়া হয়।’
জানে আলম অপু ওয়েস্টিনের সামনে উপদেষ্টা আসিফ ভূঁইয়ার সঙ্গে দেখা ও কথা হওয়ার বিষয়ে যে দাবি করেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই দিন গুলশান এলাকায় গিয়েছিলাম কিনা মনে করতে পারছি না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি সিসিটিভি ফুটেজের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করা হয়, ওয়েস্টিনের সামনে ভোরবেলা মোটরসাইকেলে যাওয়া ব্যক্তিটি আসিফ মাহমুদ। এ বিষয়ে আসিফ মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজে হেলমেট পরা যে কাউকে যদি আমাকে বলে দাবি করা হয়, এটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? আমি এ বিষয়ে আর বেশিকিছু বলতে চাই না। তদন্তাধীন বিষয় যেহেতু।’
প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুলাই সন্ধ্যায় গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডে সাবেক এমপি শাম্মীর বাসায় চাঁদার টাকা আনতে গিয়ে গ্রেফতার হয় ৫ জন।
তারা হলেন—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান ওরফে রিয়াদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহীম হোসেন মুন্না, ঢাকা মহানগর শাখার সদস্য মো. সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাব এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী মো. আমিনুল ইসলাম। গত ১ আগস্ট গ্রেফতার হয় চাঁদাবাজির আরেক হোতা জানে আলম অপু। তাদের সবাইকে নিজ নিজ সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর আগে গত ১৭ জুলাই সকালে শাম্মীর বাসা থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা আনে এই চক্র।
Leave a Reply