রাজধানী লাগোয়া শিল্পনগরী টঙ্গী। শিল্পনগরী এই টঙ্গীকে ‘মাদকের হাট’ও বলা হয়। এখানকার প্রায় প্রতিটি বস্তিতে চলে মাদকের রমরমা কারবার। প্রশাসনের মাদকবিরোধী অভিযান ও কড়া নজরদারিতে মাদক ব্যবসায় কিছুটা ছেদ পড়লেও বস্তিগুলোতে থেমে নেই এই সর্বনাশা নেশার কারবার।
এখানকার মাদক ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ নারী। এসব মাদ্রকসম্রাজ্ঞী মাদকের কারবার করে গড়েছেন বিপুল সম্পদ, গাড়ি-বাড়ি। অনেকে তার পরও থাকেন বস্তিতে। কারণ কী?
মাদকের কারবার। টঙ্গীর বস্তিগুলোতে হরদম বিক্রি হচ্ছে মাদক। তবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে। অপরিচিত কারও কাছে মাদক বিক্রি করেন না ব্যবসায়ীরা।
তরঙ্গ টি-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে টঙ্গীর বস্তিগুলোর মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি।জেল থেকে সোজা বস্তিতে তিন বাড়ির মালিক মোমেলা
টঙ্গীর আলোচিত মাদকসম্রাজ্ঞী মোমেলা বেগম (৪০)। থাকেন মাদক অধ্যুষিত টঙ্গীর কো-অপারেটিভ ব্যাংক মাঠ বস্তিতে। এক যুগ ধরে বস্তিতে বসে চালিয়ে যাচ্ছেন মাদক ব্যবসা। তাতে গড়ে তুলেছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। খোদ টঙ্গীতেই রয়েছে মোমেলার তিনটি অলিশান বাড়ি ও একাধিক গাড়ি। একাধিক বাড়ি-গাড়ি থাকা সত্ত্বেও বস্তি ছাড়েননি মোমেলা।
মাদক মামলায় একাধিকবার জেল খেটে জামিনে বের হয়ে ফের বস্তিতে গিয়ে ওঠেন তিনি। সেখানে বসে আবার চালিয়ে যান মাদক ব্যবসা। স্থানীয় সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ও প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এক যুগ ধরে চলছে মোমেলা বেগমের মাদক সাম্রাজ্য।
মোমেরা মাদক বিক্রির টাকায় টঙ্গীতে কিনেছেন তিনটি বাড়ি। ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের মরকুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন কুদ্দুস খলিফা রোডে ‘জাহিদ হাসান ভিলা’ নামে একটি বহুতল বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে তার। একই ওয়ার্ডের শিলমুন পূর্বপাড়া যুগীবাড়ি রোডে মাতৃকোল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির স্বপন মাস্টারের কাছ থেকে কেনেন অর্ধকোটি টাকার একটি বাড়ি। পুবাইলের করমতলা পূর্বপাড়া আবাসিক এলাকায় পৌনে ৪ কাঠা জমির ওপর একটি আধাপাকা বাড়ি রয়েছে তার। ব্যাংক মাঠ বস্তিতে রয়েছে একাধিক আধাপাকা ঘর।
এ ছাড়া টঙ্গী ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় মোমেলার রয়েছে নামে-বেনামে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ।সূত্র জানায়, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোমেলার বিরুদ্ধে টঙ্গী পূর্ব থানা, গাজীপুর ডিবি, র্যাব ও গাজীপুর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ১৭টি মাদক মামলা হয়।এ বিষয়ে জানতে মোমেলার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন মাস চারেক আগে। বলেন, ‘ব্যাংক মাঠ বস্তির প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ঘুরেফিরে শুধু আমার নামেই মামলা হয়। তিন-চার মাস আগে আমি মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি।’
সম্পদের বিষয়ে মোমেলা বলেন, ‘টঙ্গীর মরকুনের বাড়িটি আমার নামে কেনা। সমিতির স্বপন মাস্টারের কাছে টাকা পাওনা ছিল, তাই তার কাছ থেকে বাড়িটি আমার মা লতিফা বেগমের নামে কিনেছি। পুবাইলের বাড়িটি আমার স্বামী জাহাঙ্গীর জমি বিক্রি করে কিনেছেন। একটা প্রাইভেটকার কেনা হয়েছে মা লতিফা বেগমের নামে, যার নমিনি আমি।’ এ ছাড়া একটি পিকআপ ও সিএনজি কিস্তিতে কেনা হয়েছে বলে জানান মোমেলা।এত সম্পত্তি থাকার পরও কেন বস্তি ছাড়েননি- জানতে চাইলে মোমেলা বলেন, ‘বস্তিতে ১৫-২০টি ছাগল পালন করি। তাই বস্তি ছেড়ে যেতে পারিনি।’
ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ময়না বেগম ব্যাংক মাঠ বস্তির আরেক মাদকসম্রাজ্ঞী ময়না বেগম। তিনি স্থানীয় ৫৬ ননম্বর ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মাদক মামলা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নামিদামি গড়িতে চড়ে ময়না বেগমের কাছে আসেন মাদকসেবীরা। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে ময়না বেগম মাদকের চালান এনে তা বুঝিয়ে দেন তার একাধিক বিক্রেতার (সেলারের) কাছে। ফলে বিভিন্ন সময় পুলিশের অভিযানে মাদকসহ ময়নার সহযোগীরা গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান ময়না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ময়না বেগমের পুরো পরিবার মাদক ব্যবসায় জড়িত। তার মেয়ে নার্গিস প্রশাসনের তালিকাভুক্ত অন্যতম শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় রয়েছে অন্তত এক ডজন মাদক মামলা। একাধিকবার র্যাব ও পুলিশের হাতে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ গ্রেপ্তার হন নার্গিস।
ব্যাংক মাঠ বস্তির বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে ময়না বেগমের বেতনভুক্ত পাহারাদার। প্রশাসন কিংবা সন্দেহভাজন কোনো লোকজন বস্তিতে প্রবেশ করলে সেই খবর পৌঁছে যায় ময়নার কাছে।
ময়না বেগমের মাদক বিক্রির জন্য সেলার হিসেবে কাজ করেন রানী (৪০) ও রানীর ছেলে রাব্বানি (২৫)। গত শনিবার (২৯ মে) ব্যাংক মাঠ বস্তিতে ইয়াবা বিক্রির সময় ২০টি ইয়াবাসহ রাব্বানীকে গ্রেপ্তার করে টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশ।
ময়না বেগমের ছেলে তাজুল ইসলাম তাজু বস্তির অন্যতম মাদকের ডিলার। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা। ময়না ও তাজুল মাদকের টাকায় গাজীপুর ও মাদারীপুরে গড়ে তুলেছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। এসব সম্পদ নিজেদের নামে না কিনে আত্মীয়স্বজন ও শ^শুরবাড়ির লোকজনের নামে করেছেন।
টঙ্গীর শিলমুন জাম্বুরেরটেক এলাকায় তাজুল ইসলাম তার শ^শুর সোলেমান ফরাজির নামে কিনেছেন ৮.৫৯ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত একটি টিনশেড বাড়ি। মাদারীপুরের শিবচরের হিন্দুপাড়ায় রয়েছে কয়েক বিঘা জমি। অধিকাংশ সম্পদই তাজুল তার স্ত্রী রোজির নামে কেনেন। এ ছাড়া গাজীপুর ও টঙ্গীতে রয়েছে নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ।
ময়না বেগমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে নিজে ও তার পরিবারের লোকজনের একসময় মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন তিনি।
ময়না বেগম বলেন, ‘আগে একসময় জড়িত ছিলাম। ১০-১২ বছর যাবৎ জড়িত নাই। আমার পরিবারের কেউ এখন মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। আমার মেয়ে নার্গিস মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। সেও এখন মাদক ব্যবসা করে না। আর আমার ভাই কক্সবাজারে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে বের হয়েছে। বর্তমানে আরেক মামলায় কারাগারে আছে।’
শীর্ষ ফেনসিডিল ব্যবসায়ী আরফিনা টঙ্গীর ব্যাংক মাঠ বস্তির আরেক মাদক সম্রাজ্ঞী আরফিনা বেগম। এলাকায় তিনি জামালের বউ নামেও পরিচিত। বর্তমানে তিনি টঙ্গীর অন্যতম শীর্ষ ফেনসিডিল ব্যবসায়ী। কথিত আছে, টঙ্গীর কোথাও ফেনসিডিল পাওয়া না গেলেও আরফিনার কাছে সব সময় পাওয়া যায় তা। মাদক ব্যবসার কাজে আরফিনাকে সহযোগিতা করেন তার ভাই শ্রাবণ ও স্বামী জামাল। বস্তিতে বসে দেদার মাদক কারবার চালিয়ে গেলেও গত তিন বছরে আরফিনাকে টঙ্গী থানা পুলিশ একবারও আটক করতে পারেনি। অসাধু কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতার নিয়মিত মাসোহারার বিনিময়ে আরফিনা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন।নাম প্রকাশ না করা শর্তে টঙ্গী থানার সাবেক এক পুলিশ কর্মকতা ঢাকা টাইমসকে বলেন, আরফিনা ছিলেন ডিবি পুলিশের অন্যতম আয়ের উৎস। সাবেক গাজীপুর জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দুজন এসআই আরফিনাকে কয়েক দিন পরপর আটক করে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিতেন। তবে সব সময়ই থানার পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতেন আরফিনা।
এ ছাড়া ব্যাংক মাঠ বস্তির অন্যতম মাদক ব্যবসায়ীরা হলেন, রিপন মিয়া, টুক্কু, বাচ্চুর বউ, রতনা, বুতনির মা, আমির কানা, রুবিনার জামাই মৃদুল। এদের নেতৃত্বে বস্তির বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা।গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ- দক্ষিণ) মোহাম্মদ ইলতুৎ মিশ বলেন, ‘বস্তির মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যপারে তথ্য সংগ্রহ চলছে। প্রত্যেকের নামে একাধিক মাদকের মামলা রয়েছে। খুব শিগগির ব্যাপক আকারে মাদকবিরোধী অভিযান হবে টঙ্গীর বস্তিগুলোতে।’ এ ছাড়া নিয়মিতই মাদকসহ গ্রেপ্তার করে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
Leave a Reply