ডলার সংকট কেটে গেছে, বেড়েছে প্রবাহ তবুও ব্যাংকগুলোতে আমদানির এলসি খোলার প্রবণতা বাড়ছে না। এলসি খোলার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা যেমন সতর্ক, তেমনি ব্যাংকগুলোও আমদানি অর্থায়নের ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। কারণ বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা আমদানি, ব্যবসা বাড়ানো অনুকূল মনে করছেন না। সাড়ে তিন বছর ধরে চলা ডলার সংকট কাটলেও ব্যবসা, আমদানি বাণিজ্য খুব বেশি বাড়েনি। এর নেপথ্যে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে মন্দাকেও দায়ী করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে আমদানি বাণিজ্যের জন্য এলসি খোলার হার বেড়েছে মাত্র দশমিক ১৮ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি বেড়েছে ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে আমদানির এলসি ও আমদানি সামান্য বেড়েছে। তবে এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি কমেছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। এলসি বেড়েছিল দশমিক ৭৬ শতাংশ। আগের অর্থবছরগুলোতেও আমদানি কমেছিল ডলার সংকট ও করোনার কারণে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের আগস্টে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বৈদেশিক দায় শোধের পর গত অক্টোবর থেকেই ব্যাংকগুলোতে ডলারের প্রবাহ বেড়েই চলেছে। আগে রপ্তানি আয় ছিল নেতিবাচক, এখন সেটিও বাড়তে শুরু করেছে। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে বেড়েছে রেকর্ড হারে ২৫ শতাংশ। এতে ডলারের প্রবাহ আরও বেড়েছে। ফলে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বৈদেশিক দেনা এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কোটি ডলার শোধ করা হয়েছে। এছাড়া আমদানির নিয়মিত দায়ও শোধ করছে। তারপরও ডলারের প্রবাহ বাড়ছে। এর প্রভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে। কিন্তু আমদানিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি।
ব্যাংকাররা জানান, আমদানি অর্থায়নের ক্ষেত্রে এখন তারা খুব সতর্ক। কারণ খেলাপি ঋণ আর বাড়ানো যাবে না। আমদানির নামে যাতে টাকা পাচার না হয় সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকি রয়েছে। এসব কারণে এলসি খোলার ক্ষেত্রে আগে বিবেচনায় নেওয়া হয় পণ্যটি দেশে আসবে কিনা, যে কোম্পানি এলসি খুলছে তারা ব্যাংকের দায় শোধে সক্ষম কিনা। এসব বিবেচনায় নিয়ে কেবল পরীক্ষিত কোম্পানিগুলোর এলসিই খোলা হচ্ছে। বাণিজ্যিক এলসি খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান কম থাকায় এবং আমদানি অর্থায়নের বিপরীতে সুদের হার বেশি থাকায় উদ্যোক্তারা এলসি খুলতে উত্সাহিত হচ্ছে না। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৯ শতাংশ সুদে আমদানি খাতে অর্থায়ন করত ব্যাংক। এরপর থেকে এ হার বাড়তে থাকে। এখন এ খাতে অর্থায়ন করতে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ সুদ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া কোনো কোনো ব্যাংক বাড়তি চার্জ নিচ্ছে। তারা বেশি দামে ডলার কেনার কারণে এর দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে কারণে আমদানিতে খরচ বেশি পড়ছে।
এদিকে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকগুলো ও উদ্যোক্তারা এলসি খুলতে আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ বৈশ্বিকভাবে পরিস্থিতি দ্রুত ওঠানামা করছে। এ কারণে পণ্যের দামও বেশি মাত্রায় ওঠানামা করছে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতে ২০১২ সালে বৈশ্বিক মন্দার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলাসহ অনেক পণ্যের দাম কমে যায়। এতে দেশে যারা বেশি দামে পণ্য আমদানি করেছিলেন তারা ওইসব পণ্য বাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে পারেননি। উল্টো আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করেছিলেন।
এতে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে আমদানির বিপরীতে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে ওই বছর এক লাফে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। ২০১১ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে তা এক লাফে দ্বিগুণ বেড়ে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকায় উঠেছিল। এরপর ২০১৩ সালে সামান্য কমে ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকায় নেমেছিল। কিন্তু পরের বছরই আবার তা বেড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে। এরপর থেকে খেলাপি ঋণ আর কমেনি। এসব বিবেচনায় ব্যাংকগুলো এখন আমদানি খাতে অর্থায়নে খুব সতর্ক।
এছাড়া দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অনুকূল মনে করছেন না উদ্যোক্তারা। তৈরি পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছরে বাড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে এটি আগামীতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়বে। উদ্যোক্তারাও তাই মনে করেন।
Leave a Reply