কখনো কখনো দৃশ্য কেবল চোখে দেখা যায় না—তা হৃদয়ে বাজে, নিঃশব্দে কাঁপায় আত্মাকে। মিশরের উপকূলে এমনই এক দৃশ্য ঘটেছে—মানুষ বোতলে খাবার, পানি, শুকনো রুটি ও প্রার্থনার ছোট ছোট বার্তা ভরে সাগরের ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে গাজার উদ্দেশ্যে। পথ নেই, পারাপারের কোনো সুযোগ নেই—তবু তারা থেমে নেই। তারা ভরসা রেখেছে আল্লাহর ওপর, আস্থা রেখেছে সাগরের ঢেউয়ের হাতে। যেন ঢেউ নয়, এ এক নীরব দূত, মিশরের হৃদয় থেকে গাজার দরজায় গিয়ে কড়া নাড়বে।
এই অদ্ভুত অথচ অভাবনীয় বিশ্বাসের পেছনে একটি প্রাচীন সত্য কাহিনি হয়তো আজও ধ্বনিত হয়ে চলছে। বহু শতাব্দী আগে এমনই এক ঘটনার কথা মানুষ শুনেছিল এক নবীর মুখে—যেখানে সাগর হয়ে উঠেছিল সাক্ষ্য, আর একটি কাঠের টুকরো হয়ে উঠেছিল বিশ্বাসের বাহক।
বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি অপরের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছিলেন। কোনো সাক্ষী বা জামিন ছাড়া, শুধু আল্লাহকে সাক্ষী রেখে। কাজ শেষে সে যখন ঋণ ফেরত দিতে চাইল, তখন কোনো বাহন পেল না। তার অন্তর পোড়াতে লাগল দায়বদ্ধতার তীব্রতা। তাই সে এক টুকরো কাঠের ভেতর ঋণের অর্থ ও একটি চিঠি রেখে তা সাগরে ছেড়ে দিল। সে জানত না কাঠটি আদৌ গন্তব্যে পৌঁছাবে কি না, কিন্তু জানত—আল্লাহর কাছে তার নিয়ত পৌঁছে যাবে।
অপরদিকে ঋণদাতা উপকূলে এসে প্রতীক্ষায় ছিল। হঠাৎ সে পায় একটি কাঠের টুকরো, ভেতরে পায় ঋণের অর্থ ও সেই চিঠি। কিছুদিন পর ঋণগ্রহীতা নিজেও এসে হাজির হয়, হাতে আরেকবার সেই অর্থ নিয়ে। তখন ঋণদাতা বলে—সাগরের ঢেউ তোমার পক্ষ হয়ে তা পৌঁছে দিয়েছে।
এই আস্থা, এই অলৌকিকতার গল্প শুধু গল্প নয়—এ এক চিরন্তন পাঠ: যখন মানুষের সমস্ত চেষ্টার সীমা ফুরিয়ে যায়, তখন আল্লাহর অসীমতা শুরু হয়। সেই কাঠের টুকরো আজ যেন পুনর্জন্ম নিয়েছে মিশরের উপকূলে, বোতলের গায়ে লেখা দোয়া আর খাবারের মোড়কে—‘হে আল্লাহ, আমাদের পক্ষ থেকে তুমি পৌঁছে দাও।’
এই দৃশ্য শুধুই মানবিক নয়, এটি হৃদয়ের কান্না, এক নীরব বিপ্লব। যেখানে কেউ প্রতিবাদ করেনা মুখে, কিন্তু সমুদ্রের ঢেউ হয়ে তা পৌঁছে দেয় নিপীড়িতের দরজায়। মিশরের সাধারণ মানুষ জানে তারা গাজায় পৌঁছাতে পারবে না, কিন্তু জানে—আল্লাহ পৌঁছাতে পারেন।
গাজার দিকে ভেসে চলা প্রতিটি বোতল যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে—ভালোবাসা কখনো অবরুদ্ধ হয় না, মানবতা কখনো থেমে যায় না, আর আল্লাহর কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। এই বোতলগুলো কেবল খাবার বহন করছে না, এগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি জাতির বেদনাভরা হৃদয়, যাদের হাতে কিছু নেই, কিন্তু অন্তরে আছে আকাশচুম্বী তাওয়াক্কুল।
আজকের এই পৃথিবীতে, যখন সীমান্ত দেয়াল হয়ে ওঠে, তখন একটি বোতল সমুদ্রের বুকে ভেসে বলে—আমরা এখনও বেঁচে আছি, এখনও ভালোবাসি, এখনও ভরসা করি।
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
তথ্যসূত্র,
The New Arab
Leave a Reply