পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার চিড়াপাড়া পার-সাতুরিয়া ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামের প্রশান্ত মন্ডল। চার বছর আগে হার্টের সমস্যায় মায়ের মৃত্যু হয়। মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে হবে ডাক্তার। প্রশান্ত মন্ডল সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন। মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় ২৮৫২তম হয়ে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু অর্থাভাবে তার মেডিকেলে ভর্তি হওয়া এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
দারিদ্র্যকে জয় করে ছেলে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেলেও দিনমজুর বাবার কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ, কীভাবে ভর্তি করবেন ছেলেকে। স্ত্রীকে ছাড়াই কোনো রকমে চার সন্তানকে নিয়ে অভাবের সংসার চালাচ্ছেন প্রশান্তের বাবা গৌরাঙ্গ লাল মন্ডল। ছেলেকে মেডিকেলে ভর্তি এবং তার লেখাপড়ার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন সেটা কোথায় পাবেন সেই চিন্তায় আছেন তিনি।
চার ভাই-বোনের মধ্যে প্রশান্ত তৃতীয়। বসতভিটা ছাড়া তাদের তেমন কোনো সম্পত্তি নেই। বাবা অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে যা রোজগার করেন তা দিয়ে চলে সংসার। আর প্রশান্ত পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি ও সুযোগ পেলে অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে যা আয় করেন তা দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি পরিবারকেও সহায়তা করেন।
এলাকাবাসী ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, প্রশান্ত ২০২১ সালে নীলতি সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক শেষ করে। এরপর পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ ভর্তি হয়। ২০২৩ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেলে সুযোগ না পেলেও সুযোগ পেয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুচ্ছ এবং কৃষি উৎসগুলোতে। কিন্তু মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টায় কোথাও ভর্তি না হয়ে অবশেষে ২০১৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অসাধ্য সাধন করল প্রশান্ত। এ বছর এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় প্রশান্ত অংশ নিলে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। কিন্তু ভর্তিসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ যে অর্থের দরকার তা প্রশান্তের হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ দিনমজুরি করে যে টাকা আয় করেন প্রশান্তের বাবা, তাতে সংসার চালাতেই কষ্ট হয়ে যায়।
প্রশান্ত মন্ডলের বাবা গৌরাঙ্গ লাল মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে অনেক কষ্ট করেছে। এমনও দিন গেছে সকালে বাড়ি থেকে না খেয়ে কলেজে গেছে। কলেজ শেষ করে টিউশনি করে রাত ৮টায় বাড়ি ফিরেছে। টিউশনির টাকায়ই নিজে পড়াশোনা করছে। টিউশনি না থাকলে আমার সাথে দিনমজুরির কাজ করছে। কষ্ট করছে ভালো ফল করছে। কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় এখন ওরে অর্থাভাবে ভর্তি করতে পারি কিনা সন্দেহ। মেডিকেলে চান্স পাওয়ায় গর্বে আমার বুক ভরে যায়। কিন্তু ভর্তি তারপর পড়াশোনা করতে যে টাকা খরচ হবে তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দেশবাসীর কাজে আমার অনুরোধ ওর দিকে যদি সবাই একটু খেয়াল দিত তাহলে আমাদের উপকার হইতো।
প্রশান্ত মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমার মা হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। অর্থের অভাবে আমার মাকে ঠিকভাবে চিকিৎসাও করাতে পারিনি। আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি বড় হয়ে একজন ডাক্তার হবো। আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতেই মেডিকেলের ভর্তি যুদ্ধে দ্বিতীয় বারও অংশ নিয়েছি। লেখাপড়ার খরচ জোগাতে মাঠে কাজ করেছি। কারণ আমার পরিবারের পক্ষে এত লেখাপড়া চালানো সম্ভব ছিল না। আমার অক্লান্ত পরিশ্রম ও মা-বাবার দোয়ায় সৃষ্টিকর্তা আমাকে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ দিয়েছেন। দোয়া করবেন যেন ঠিকভাবে পড়াশোনা করে একজন কার্ডিওলজিস্ট হতে পারি। যাতে করে আমার মায়ের মতো গ্রামের আর কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা না যান।
নিলতি সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা জাকিয়া খানম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রশান্ত মন্ডল আমাদের বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। তখন থেকেই প্রশান্ত ছিল খুব মেধাবী। সব সময় নিজের চেষ্টাতেই পড়ালেখা করেছে। সে প্রমাণ করেছে জীবনে বড় হতে হলে কোনো বাধাই বাধা নয়। স্বপ্ন ছোঁয়ার ইচ্ছে থাকলে দারিদ্র্যকেও জয় করা যায়। শিক্ষক হিসেবে প্রশান্তের সফলতায় আমরা গর্বিত।
এ বিষয়ে কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্বজল মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটা দরিদ্র পরিবার থেকে প্রশান্ত মন্ডলের এমন সাফল্যের বিষয়টি শুনে আমরা খুব আনন্দিত। তার যদি কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হয় আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে আমরা উপজেলা প্রশাসন থেকে যথাযথ সহায়তা করব।