কেউ বলেন ভূস্বর্গ, কেউ বলেন উপমহাদেশের সুইজারল্যান্ড। যারা বেড়াতে ভালোবাসেন, জম্মু ও কাশ্মির তাদের কাছে প্রকৃত অর্থেই স্বর্গরাজ্য। বহুবছর ধরে চলে আসা রাজনৈতিক টানাপোড়েন, উগ্রবাদী হামলার ক্ষত সারিয়ে, করোনার প্রকোপ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল এর রাজ্যের পর্যটন শিল্প। মঙ্গলবারের জঙ্গি হামলা জম্মু-কাশ্মিরের অর্থনীতির চালিকাশক্তি সেই পর্যটন শিল্পকেই ফের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
আতঙ্কে বাতিল হচ্ছে বুকিং
মঙ্গলবার দুপুরে পহেলগাঁওয়ের ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই উৎকণ্ঠার পরিবেশ তৈরি হয়। যে পর্যটকরা সেখানে ছিলেন তারা ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন। শ্রীনগরের হস্তশিল্প ব্যাবসায়ী ফিরোজ আহমেদ শেখের দোকানও পর্যটক-নির্ভর। ডিডাব্লিউয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, “যে হোটেল এবং পর্যটন সংস্থার সঙ্গে আমি কাজ করি তারা জানিয়েছে যে একের পর এক বুকিং বাতিল হচ্ছে। ট্যুর কোম্পানিগুলি বুকিং-এর টাকা ফেরত নিয়ে নিচ্ছে। আগামী মে মাসও আমাদের জন্যও সুসময় হওয়ার কথা ছিল। এখন সবই বিশ বাঁও জলে।”
মুম্বাইয়ের ভিপি ট্রাভেলসের কর্ণধার জিতুল মেহতা জানান, এই মুহূর্তে তাদের কাশ্মিরের সব বুকিং স্থগিত রাখা আছে। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, “এখনো কেউ ক্যানসেল করেননি। আমার ক্লায়েন্টরা জানিয়েছেন তারা ১০ থেকে ১৫ দিন অপেক্ষা করে কাশ্মীরের পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন। অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।” মে-জুন মাসে তার কাছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জনের কাশ্মীর যাত্রার বুকিং ছিল।
তবে বুকিং বাতিলের সংখ্যাও বেশ বেশি। কলকাতার এআরইএস ট্রাভেলের কর্ণধার অনিল পাঞ্জাবি ডিডাব্লিউকে জানান, তাদের কাশ্মিরের যা বুকিং ছিল তার অধিকাংশই বাতিল করতে চান পর্যটকরা। তিনি বলেন, “মোট বুকিং-এর ৭০ শতাংশ বাতিল হয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে বাকি ৩০ শতাংশ ক্যানসেল হয়ে যাবে। কাশ্মির এই মুহূর্তের খুব জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই ধাক্কা সামলানো কঠিন হবে।”
সিটি ট্রাভেলসের বিলোলাক্ষ দাস জানান, তারা দলবদ্ধ বুকিং নেন। ছয় জন থেকে ১৫ জনের দল হয়। মে মাসে প্রায় পাঁচ-ছয়টি দলের বুকিং ছিল। এক এক করে বাতিল হচ্ছে প্রায় সবকটাই।
প্রশ্নের মুখে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা
জম্মু-কাশ্মীরে পর্যটন শিল্প থেকে বার্ষিক আয় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এর উপর নির্ভরশীল প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ। ২০১৯-এ আর্টিকল ৩৭০ প্রত্যাহার করে মোদী সরকার। জম্মু কাশ্মীর সরকারের পর্যটন দফতরের হিসেবও অনুযায়ী সেই বছর সাড়ে পাঁচ লক্ষের কিছু বেশি মানুষ বেড়াতে গেছিলেন কাশ্মীরে। কোভিডের কারণে ২০২০-২০২১ এ মার খেলেও, ২০২২ থেকে ঘুরে দাঁড়ায় কাশ্মীরের পর্যটন। ২০২২ এবং ২০২৩ সালে প্রায় ২৭ থেকে ২৮ লক্ষ মানুষের ভিড় জমে কাশ্মীরে। গরমের ছুটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাশ্মীরে হোটেল, হোমস্টে প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ। এরকম অবস্থায় পর্যটকদের উপর জঙ্গিহানায় প্রমাদ গুনছেন সেখানকার ব্যাবসায়ী সম্প্রদায়।
ফিরোজ বলেন, “এখানে পর্যটন এতটাই উন্নতি করল যে বিভিন্ন হোটেল ঘরের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করছিল। বিদেশের হোটেল প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছিল। আমাদের মতো স্থানীয় ব্যাবসায়ীরাও এর ফল পাচ্ছিলাম। তার মধ্যে এই ঘটনা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় কারো নজর লেগেছে।”
কাশ্মির বাতিল হলেও পর্যটকরা অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। অনিল বলেন, "কাশ্মীরের পর্যটকরা সেখানে যেতে না পারলে পাহাড়ই খোঁজেন। সেক্ষেত্রে হিমাচল, সিকিম, এমনকি দার্জিলিং-এর খোঁজ নিচ্ছেন তারা।"
তবে বুকিং বাতিল শুরু হলেও তার পথ খুব মসৃণ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রিম টাকা নেয়া হয়েছে। সেই টাকা চলে গেছে, হোটেল, গাড়ি বা ট্যুর গাইডদের কাছে। বিলোলাক্ষ জানান, “বুকিং বাতিলের দীর্ঘ পদ্ধতিগত পথ রয়েছে। পর্যটকরা চান অগ্রিম বুকিং-এর টাকা ফেরত পেতে। নতুবা সেই টাকায় অন্যত্র বেড়াতে যেতে। আমরা যেখানে অগ্রিম দিয়েছি সেখান থেকে টাকা কী করে বা কতখানি ফেরত পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে কথাবার্তা চলছে।”