হাসনাইন সাজ্জাদী বাংলা কবিতায় একটি স্বতন্ত্র কাব্যধারা ও ভাষা নির্মাণের প্রয়াসে নিবেদিত কবি। তিনি ‘কবিতাবিজ্ঞান’ বা Science Poetry-এর প্রবর্তক হিসেবে বিজ্ঞান ও কল্পনার মধ্যকার সংযোগ স্থাপন করেছেন অভিনব কৌশলে। পাশাপাশি তাঁর কবিতায় উপস্থিত রয়েছে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, নান্দনিকতা, ছন্দ, সমসাময়িক বাস্তবতা ও এক ধরনের মানবতাবাদী, সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গি।
সাজ্জাদীর কবিতায় উপমা ও উৎপ্রেক্ষা একদিকে যেমন ভাবের গভীরতা তৈরি করে, অন্যদিকে কবিতার বিমূর্ত বিষয়কেও পাঠযোগ্য ও চিত্রাত্মক করে তোলে। যেমন – “কবির কল্পনার রাজ্য আর কতটুকু বিস্তৃত হবে” – এখানে কল্পনার সীমা প্রসঙ্গে উৎপ্রেক্ষা এক বিশাল ভাবমূর্তি নির্মাণ করে।
তাঁর ‘মা দিবসে মায়ের স্মরণে’ কবিতায় মায়ের মৃত্যু, দাদার স্মৃতি, অসুস্থতা ইত্যাদির বিবরণে উৎপ্রেক্ষার আবেগ ও চিত্রময়তা মানবিক মাধুর্যকে স্পর্শ করে।
তাঁর কবিতায় যেমন আমরা পাই বিমূর্ত ভাবনার চিত্ররূপ, তেমনই পাই সামাজিক বাস্তবতার নিরেট চিত্র—“এই শহরের যানবাহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসুক / আমি এমনটা চাই বরাবরের মতো” –
এখানে কবি কল্পনার বদলে বাস্তব শহরের একটি প্রয়োজনীয় সামাজিক কাঠামোর উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন, যা আধুনিক কবিতার নাগরিক চেতনার পরিচায়ক।
সাজ্জাদীর কবিতার অন্যতম শক্তি তাঁর সময়চেতনা। তিনি ক্ষমতা, দারিদ্র্য, অনাহার, জনস্বার্থ, বিজ্ঞানের গুরুত্ব ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অসঙ্গতিকে উপজীব্য করে কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর “মানবতার জয় হোক” কবিতায় উঠে আসে ক্ষমতার লোভ, দরিদ্র মানুষের দুর্দশা, ও শোষণের বাস্তবতা—”ক্ষমতা গ্রহণ করে অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের দিকে তাকায় না / আফসোস!”
এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে কেবল একজন কবি নয়, বরং একজন সমাজ-সচেতন, দার্শনিক চিন্তার অধিকারী লেখকে পরিণত করেছে।
হাসনাইন সাজ্জাদীর কবিতার গভীরতায় যে ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতা রয়েছে তা প্রত্যক্ষ নয়, কিন্তু ভাবনায়, লক্ষ্যবস্তুতে এবং ভাষার ব্যবহারেই তা সুস্পষ্ট। তিনি বিশ্বাস করেন কবিতা মানুষের কল্যাণের জন্য, তা কোনো ধর্মীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়।
‘মানবতার জয় হোক’ কবিতায় তিনি বলেন—”আমি চাই ক্ষুধা মুক্ত পৃথিবী হোক / অসুখ বিসুখ মুক্ত সুস্থ সমাজ আমি চাই” –
এটি এক ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার জয় চায়।
কবিতাবিজ্ঞানের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও কল্পনা যেমন মিলেছে, তেমনি ধর্ম নয়, বরং বিজ্ঞান, যুক্তি ও মানবিক চেতনা তাঁর কবিতার নিয়ন্তা, যা সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গির নিদর্শন।
তাঁর কবিতার ভাষা স্বচ্ছ, কখনও বর্ণনামূলক, কখনও সংক্ষিপ্ত বাক্য বিন্যাসে ছন্দ তৈরি করে। কোনো কোনো কবিতায় প্রচলিত অন্ত্যমিল না থাকলেও অন্তর্নিহিত ছন্দবোধ কাজ করে যা পাঠককে আবেগে আন্দোলিত করে।
হাসনাইন সাজ্জাদীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যিক অবদান হলো তাঁর ‘কবিতাবিজ্ঞান’ তত্ত্ব। তিনি মনে করেন, কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ও বাস্তব প্রয়োগ থাকা উচিত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিজ্ঞান ও কবিতা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং পরিপূরক।
তিনি বলেন—“কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের বিজ্ঞানই কবিতাবিজ্ঞান”
তাঁর বিজ্ঞান-কেন্দ্রিক কবিতাগুলোতে পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান বা রসায়নের ধারণা উপমার মাধ্যমে উঠে আসে, যা কবিতার দৃষ্টিভঙ্গিকে বৈজ্ঞানিক, যুক্তিনিষ্ঠ ও আধুনিক করে তোলে।
হাসনাইন সাজ্জাদী বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার সূচনা করেছেন যেখানে উপমা ও উৎপ্রেক্ষা যেমন সাহিত্যিক, তেমনি বাস্তবিক। তাঁর কবিতা ব্যক্তি-মানুষের অন্তর্জগৎ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, সমাজ, সময় ও বিজ্ঞানের পরিসর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর ‘কবিতাবিজ্ঞান’ তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন ব্যাকরণ দিয়েছে, এবং তা বিশ্বসাহিত্যের দরবারে এক অনন্য অবদান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সর্বোপরি, তাঁর কবিতায় সেকুলারিজমের অন্তর্নিহিত বার্তা আজকের সময়ের জন্য এক মূল্যবান সংযোজন।