1. tv@tarangotv.com : তরঙ্গ টিভি : তরঙ্গ টিভি
  2. info@www.tarangotv.com : তরঙ্গ টিভি :
শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ন

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট শুরু হয়েছে চিকিৎসাসেবা, খুশিতে আবেগ-আপ্লুত রোগীরা

প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত: সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫
  • ৪০ বার পড়া হয়েছে

ঈদের দিন থেকে চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল টাঙ্গাইলের আনোয়ার হোসেনের। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসে দেখেন হাসপাতাল বন্ধ। নিরুপায় হয়ে হাসপাতালের নিচতলার বেঞ্চেই রাত কাটান তিনি।

কিশোরগঞ্জের সাদিয়া দুবার হাসপাতালে এসে ফিরে গিয়ে আবার এসেছেন আশায় বুক বেঁধে- যদি খুলে হাসপাতাল! নোয়াখালীর গনি নামে এক ব্যক্তি চোখে কিছুই দেখছেন না, হাসপাতালের বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু প্রহর গুনছিলেন কখন খুলবে।

হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা এমন অসংখ্য রোগী অপেক্ষার প্রহর গুনছেন গত ১৮ দিন ধরে।

অবশেষে গতকাল শনিবার (১৪ জুন) হাসপাতালের দরজা খুলেছে, ফিরেছেন চিকিৎসক-নার্সরা। আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে সেবা। ফলে রোগীদের মধ্যে ফিরেছে স্বস্তি। অনেকেই বলছেন, ‘চোখে যেন আলো ফিরেছে চিকিৎসা সেবা ফিরে আসায়।’

রোববার (১৫ জুন) সকালে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় হাসপাতালের সব সেবা শুরু হয়েছে। চিকিৎসক-নার্স সবাই ব্যস্ত সেবাদানে। রোগীরাও লাইন ধরে টিকিট কেটে সেবা নিচ্ছেন।

হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে সকাল থেকেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন শতাধিক মানুষ। কেউ এসেছেন চোখের ব্যথা নিয়ে, কেউ বা অপারেশনের সময় ঠিক করতে, আবার কেউ পুরোনো অসুস্থতার চেকআপের জন্য। ফটকের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে রোগীদের ভিড়। বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারে ছিল উপচে পড়া ভিড়। জরুরি বিভাগেও ছিল রোগী-স্বজনের আনাগোনা। পেছনের ১৮ দিনের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে সবাই যেন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুরোদমে হাসপাতাল চালু হওয়ার পর আজ ভোর থেকেই রোগী ও স্বজনদের ভিড় বাড়তে শুরু করে হাসপাতালের মূল ফটকে। বেলা ১১টার দিকেই বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েকশতে। তখনো টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন দেখা যায়।

সেবা বন্ধ থাকায় আবাসিক হোটেলে থেকে অপেক্ষা

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থেকে আসা সাদিয়া আক্তার বললেন, ‘আমি গত এক মাস ধরে চোখের যন্ত্রণায় ভুগছি। ঈদের আগে একবার ঢাকায় এসেছিলাম। তখন হাসপাতাল বন্ধ থাকায় দুই দিন অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু ব্যথা কমেনি। ঈদের পর আবার ঢাকায় আসি। তখনও জানানো হয় যে চিকিৎসা পুরোপুরি শুরু হয়নি। তাই কয়েকদিন একটি আবাসিক হোটেলে থেকে অপেক্ষা করি। আজকে সকালবেলা হাসপাতালে চলে এসেছি। চিকিৎসা শুরু হয়েছে দেখে খুব ভালো লাগছে। এই সেবা যেন আর বন্ধ না হয়। কারণ, আমাদের মতো গরিব মানুষদের কাছে এই হাসপাতালই শেষ ভরসা।’

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থেকে আসা আনোয়ার হোসেনের অভিজ্ঞতা আরও কষ্টের। তিনি বলেন, ‘গত ৭ জুন, ঈদের দিন সকালে এলাকায় শত্রুতা করে বাঁশ দিয়ে আমার চোখে আঘাত করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ ফেটে যায়। মাথা, কান, মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। সেদিনই টাঙ্গাইল সদর হাসপাতাল থেকে আমাকে এই চক্ষু ইনস্টিটিউটে রেফার করে। কিন্তু এখানে এসে দেখি হাসপাতাল বন্ধ। আমাকে নিচতলার বেঞ্চে ফেলে রাখে। ঈদের দিন থেকে বেঞ্চেই রাত কাটিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে বলে সিট নাই, পরে একটা বেড পাই। কিন্তু চিকিৎসা তেমন পাইনি। শুধু স্যালাইন আর ব্যথার ওষুধ। কেউ তেমনভাবে দেখত না। আজ থেকে চিকিৎসকরা নিয়মিত আসছেন। এখন একটু একটু করে ব্যথা কমছে। মনে হচ্ছে, এবার হয়তো আমার চোখটা রক্ষা পেতে পারে।’

হাসপাতাল যেন কখনো বন্ধ  না হয় 

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল শুধু রাজধানীর নয়, দেশের একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত চক্ষু হাসপাতাল। এখানে আছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, দেশের অভ্যন্তরে অন্য কোথাও যা নেই। প্রতিদিন গড়ে ৫০টির বেশি চক্ষু অপারেশন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হয়। শুধু রাজধানী নয়, বরিশাল, কুষ্টিয়া, রংপুর, রাজশাহী—সব অঞ্চল থেকেই রোগী রেফার হয়ে আসেন এখানে।

চক্ষু রোগীদের জন্য বিশেষায়িত এই হাসপাতাল যেন আর কখনো বন্ধ না থাকে—এমন দাবি করছেন সব রোগী। দীর্ঘ ভোগান্তির পর চিকিৎসা ফেরায় রোগীদের মুখে এখন স্বস্তির ছাপ। হাসপাতালের করিডোরে ছুটে চলা রোগীরা আজ আর আতঙ্কে নেই, বরং চিকিৎসা পাচ্ছেন—এটাই তাদের কাছে বড় প্রাপ্তি। সেবা পেতে গিয়ে রক্ত ঝরানো রোগীরাও বলছেন, ‘হাসপাতাল খুলল, এখন মনে হচ্ছে চোখে আলো ফিরেছে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা আব্দুল গনি নামে এক স্বজন জানান, ডান চোখে আঘাত লাগা ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন তিনি। বলেন, ব্রাহ্মনবাড়িয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে ভাইকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকায় এসে দেখি হাসপাতাল বন্ধ। তখন বলে শনিবার খুলবে। আমরা আত্মীয়ের বাসায় থেকে গেছি। আজকে এসে ডাক্তার দেখালাম। এখন একটু ভালো লাগছে।

তিনি আরও বলেন, চোখের চিকিৎসার জন্য সঠিক জায়গা ভেবে ঢাকায় এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে গেট বন্ধ দেখে হতবাক হয়ে যাই। আমরা তো জানতাম না এত বড় ঝামেলা হয়েছে। তারপর শুধু অপেক্ষা। আজকে ডাক্তার দেখাতে পেরে মনে হচ্ছে, অপেক্ষাটা সার্থক হলো।

মো. শাহীন নামে এক ভর্তি রোগী বলেন, আজকে যেভাবে ডাক্তাররা কাজ শুরু করছেন, ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে রোগীদের দেখছেন, মনে হচ্ছে আবার পুরোনো অবস্থা ফিরে আসছে। আমরা চাই, আর কোনোদিন যেন হাসপাতাল বন্ধ না হয়। চিকিৎসা পাওয়া আমাদের মৌলিক অধিকার।

তিনি আও বলেন, এতদিন আমরা কী অবস্থায় ছিলাম, কেউ বুঝবে না। খাবার, চিকিৎসা—সবই ছিল অনিশ্চিত। এখন আবার চিকিৎসা হচ্ছে। বাঁচা গেল। কিন্তু এমন ঝামেলা যেন আর না হয়।

চিকিৎসকদের অঙ্গীকার ‘আর কেউ চিকিৎসাবঞ্চিত হবেন না’

হাসপাতালের ভেতরে ঘুরে দেখা গেল, চিকিৎসকরা একদম আগের মতো কাজ করছেন। কেউ পেশেন্ট ফলোআপ নিচ্ছেন, কেউ অপারেশনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, আবার কেউ ইমার্জেন্সি কেস সামলাচ্ছেন। সব মিলিয়ে যেন ১৮ দিনের ক্ষত ভুলে নতুন করে শুরু করার চেষ্টা। চিকিৎসকরা বলেন, হাসপাতাল চালু রাখা আর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার দায়িত্ব মূলত প্রশাসনের।

চিকিৎসকরা বলেন, আমরা চাই প্রত্যেক রোগী যেন চিকিৎসা পান, হাসপাতাল যেন জনগণের জায়গা হয়। এজন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে এই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ক্ষুণ্ন না হয়।

হাসপাতালটির সহকারী অধ্যাপক ও আহতদের চিকিৎসা সমন্বয়ক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা বলেন, ‘আজ সকাল থেকেই সব বিভাগে পূর্ণভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, কোনো রোগী যেন ফেরত না যান। ডাক্তার-নার্স সবাই আগের জায়গায় ফিরে এসেছেন। এখন আমাদের মূল কাজ হলো, রোগীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।’

অন্য এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই হাসপাতালটা দেশের লাখ লাখ মানুষের জন্য একমাত্র আশ্রয়। এটা বন্ধ রাখা উচিত হয়নি। যুদ্ধে যেমন ফিল্ড হাসপাতাল বন্ধ হয় না, চিকিৎসা বন্ধ হয় না—আমরা চাই না, ভবিষ্যতে আর এমন কিছু হোক।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন রোগী। আমরা চিকিৎসা দিতে এসেছি, এখানে রাজনীতি, সংঘর্ষ এসবের কোনো জায়গা নেই। আমরা আশাবাদী, প্রশাসন এবার থেকে আগে থেকেই সতর্ক থাকবে।’

‘জুলাই আন্দোলনকারীদের’ আর ভর্তি নয়

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন থেকে হাসপাতালটিতে ২৮ মে’র ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বা আহত ‘জুলাই আন্দোলনকারীদের’ আর ভর্তি নেওয়া হবে না। এই মুহূর্তে চারজন আহত ব্যক্তি ভর্তি আছেন, যাদের ছাড়পত্র দিতে সরকারের গঠিত কমিটি কাজ করছে। একজন ভর্তি না হলেও হাসপাতালে অবস্থান করছেন, তাকেও ছাড়পত্র দেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতাল একটি বিশেষায়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে চোখের জটিল রোগ নিয়ে রোগীরা আসেন। সাময়িক একটি ঘটনার কারণে ১৮ দিন চিকিৎসাসেবা বন্ধ ছিল, এটা কারও জন্যই ভালো হয়নি। আমরা চাই, ভবিষ্যতে হাসপাতালের সেবা কোনোভাবেই যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। যারা হাসপাতালের ভেতরে হঠাৎ বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিলেন, তাদের বিষয়ে প্রশাসনিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

পরিচালক বলেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালের সব বিভাগ চালু হয়েছে এবং পুরোদমে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। রোগীরা যেন নিরাপদ পরিবেশে চিকিৎসা নিতে পারেন, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।’

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত

ঘটনার সূত্রপাত ২৮ মে। সেদিন ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে’র আহত কিছু ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে চিকিৎসক ও কর্মীদের সঙ্গে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে এবং ঘটে সংঘর্ষ। এতে আহত হন অন্তত ১০ জন হাসপাতাল স্টাফ। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের সেবা।

৪ জুন জরুরি বিভাগ সীমিত পরিসরে খোলা হলেও পুরোপুরি চালু হতে সময় লেগে যায় আরও ১০ দিন। বহির্বিভাগ খোলে ১২ জুন, আর ১৪ জুন পুরোদমে শুরু হয় সব কার্যক্রম। ততদিনে প্রায় ২০ হাজার রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন, অনেকে জীবনের ঝুঁকিতে পড়েন।

গতকাল শনিবার (১৪ জুন) সকালে ফের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়। হাসপাতালে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া পাঁচজন জুলাই আহত রোগী ফেরত এলে তাদের হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের শনাক্ত করে ফটক থেকেই ফিরিয়ে দেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা রয়েছে—এই ঘটনায় আর যেন কোনো রাজনৈতিক উত্তেজনা না তৈরি হয়। এজন্যই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে র‍্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।

Leave a Reply

আরো সংবাদ পড়ুন
© তরঙ্গ টিভি
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট